বায়িং হাউজঃ-
বাইং হাউজ হচ্ছে আমাদের দেশে রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পের এক ধরনের ব্যবসা। যে ব্যবসাটাকে আমরা বলে থাকি ১০০% এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড বিজনেস। এখানে বায়িং হাউজ শব্দটি
বলতে বুঝায় , "বাই" মানে কেনা আর "হাউজ" শব্দটি কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ বায়িং হাউজ একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেটা মুলত ট্রেডিং হিসাবে কাজ করে থাকে। বায়িং হাউজের মূল কাজ হচ্ছে
বায়ারের সাথে যোগাযোগ করা এবং অর্ডার নেগোসিয়েট করা। এবং পরিশেষে অর্ডার কনফার্ম হয়ে গেলে সেটা কোন ফ্যাক্টরির মাধ্যমে এক্সিকিউট করিয়ে অর্ডারটি শিপমেন্টের ব্যবস্থা করাই
হল বায়িং হাউজের কাজ। আর অর্ডার যখন বায়িং হাউজের হাত ধরে ফ্যাক্টরিতে আসে তখন বায়িং হাউজটি ঐ অর্ডারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাবতীয় কাজের তদারকি, নেতৃত্ব , দেখাশুনা ইত্যাদি করে থাকে। যিনি বায়ার তিনি বিদেশী , বিদেশ থেকে তার পক্ষে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ করা বা দেখাশুনা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেকারনে বায়িং হাউজ অনেকটা বিদেশী বায়ারের প্রতিনিধি বা এজেন্ট হিসাবে কাজ করে থাকে। বায়ার যে প্রোডাক্টটি চেয়েছেন অথবা যে মানের
প্রোডাক্ট চেয়েছেন
সেই মান বা কোয়ালিটি নিশ্চিত করাটাই হচ্ছে বায়িং হাউজের প্রধানতম দায়িত্ব।
বায়িং হাউজ
যেভাবে কাজ করেঃ-
বায়িং হাউজ
সাধারনত দু’টি পদ্ধতিতে কাজ করে। যথাঃ-
১. ট্রেডিং কম্পানি হিসাবে।
২. বায়িং এজেন্ট হিসাবে।
ট্রেডিং কম্পানি হিসাবে যেভাবে কাজ করেঃ-
একটা উদাহরন দিলে ভালমত বুঝা যাবে। মনে করা যাক, একটি বায়িং হাউজ একটি বিদেশী বায়ারের সাথে অর্ডার নেগোসিয়েট করল এবং অর্ডারটি
৩.৫ ডলারে কনফার্ম হল। তখন বায়িং হাউজ এই অর্ডারটি কোন একটি ফ্যাক্টরিতে শিফট করবে এবং শিফট করার সময় তার লক্ষ্য থাকবে সে ৩.৫ ডলারের চেয়ে কত কম দামে অর্ডারটি এক্সিকিউট করতে পারে। যত কমে এক্সিকিউট করতে পারবে ততই তার প্রোফিট। ধরা যাক বায়িং হাউজ এক্ষেত্রে ৩ ডলারে অর্ডারটি এক্সিকিউট করল সেক্ষেত্রে প্রতিটি গার্মেন্টসে ৫০ সেন্ট করে তার প্রোফিট থাকবে। এই পদ্ধতিতে যদি বায়িং হাউজ কাজ করে তবে এটাই হবে ট্রেডিং কম্পানি হিসাবে কাজ করা।
বায়িং এজেন্ট হিসাবে যেভাবে কাজ করেঃ-
বায়িং এজেন্ট হিসাবে কাজ করতে গেলে যে পলিসি বা সিস্টেম অনুসরন করা হয় তা হল বায়ারকে ম্যানুফ্যাকচারারের সাথে অর্থাৎ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির সাথে লিংকেজ তৈরী করে দেওয়া। সেক্ষেত্রে বায়িং হাউজের জন্য একটি কমিশন রেখে দেওয়া হয়, যা ৫ থেকে ১০% অথবা ক্ষেত্র বিশেষে কম বেশী হতে পারে। এই ৫ থেকে ১০% কমিশন, প্রোডাক্ট শিপমেন্ট হয়ে গেলে বায়িং হাউজ গার্মেন্টস থেকে সংগ্রহ করে ।
পোশাক শিল্পে মার্চেন্ডাইজিং:-
মার্চেন্ডাইজিং সব সময় সম্ভাবনাময় একটি পেশা।এই সেক্টরে অভিজ্ঞগতা অর্জন করতে পারলে পেশা জীবনে নিশ্চয়তা অনেক বেড়ে যায়। তাছাড়া আমাদের বৈদেশিক আয়ের সিংহভাগই আসে পোশাক শিল্প থেকে,চাকরির বাজার ও ক্যারিয়ার বিবেচনা করে ,এই পেশায় অনেকেই আগ্রহী হচ্ছে। পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান গার্মেন্টস বা বায়িং হাউজ প্রত্যেকটির ক্ষেত্রেই মার্চেন্ডাইজার প্রয়োজন। তবে গার্মেন্টস মার্চেডাইজিং হলো কাঁচামাল থেকে শুরু করে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী মানসম্মত পোশাক উৎপাদন ও নির্দিষ্ট সময়ে সেগুলো ক্রেতার কাছে পৌঁছানো। সহজ ভাষায় বলতে গেলে যিনি পোশাক উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপনন পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধায়ন করেন তিনিই মার্চেন্ডাইজার। একজন মার্চডাইজারের উপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের লাভ ও লোকসান। এই ক্ষেত্রে লাভের পরিমাণ যেমন বেশি তেমনি ক্ষতির পরিমাণ ও কম নয়। সামান্য ভুলের কারনে প্রতিষ্ঠানের অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে।তাই আজ আমাদের ব্লগটি সাজিয়েছি একজন মার্চেন্ডাইজারের অত্যাবশ্যকীয় কিছু গুণাবলি নিয়ে অর্থাৎ যে কাজ গুলো
প্রোফেশনালি জানা একজন মার্চেন্ডাইজারের অত্যন্ত জরুরী। তাহলে চলুন ,বিষয়গুলো জেনে আসা যাক।
চিত্রঃ- একজন মার্চেন্ডাইজারের বায়ারের কাছে প্রেজেন্টেশন (গুগল)
প্রথমতঃ-
প্রথমত
বায়ারের পাঠানো টেকনিক্যাল শিট এবং অর্ডার শিট ভালভাবে বুঝতে হবে এবং এখানে কোন
অষ্পষ্টতা থাকা চলবে না। অর্থাৎ বায়ার যে মানের ফেব্রিক, এক্সেসোরিস ,প্রোডাক্ট কোয়ালিটি, অর্ডারের কোয়ানটিটি
ইত্যাদি
উল্লেখ করে দেন তা অবশ্যই যথাযথভাবে ফুলফিল করতে হবে। নয়তো প্রোডাক্ট বায়ার কর্তৃক রিজেক্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশী।
চিত্রঃ অর্ডার শিটের নমুনা (গুগল)
দ্বিতীয়ত:-
ফেব্রিক এবং ইয়ার্ন ভালমত চেনা । এছাড়াও কোয়ালিটি, প্রাইজ, সাপ্লাইয়ার, সোর্সিং এবং টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির
প্রোডাকশন সম্পর্কে বাস্তবতার আলোকে জানা এবং বুঝা। এই প্রতিটি বিষয় যেমন ইয়ার্ন , ফেব্রিক, গার্মেন্টসের প্রোডাকশন পর্যায় থেকে ইহার কনজাম্পশন এবং কস্টিং সম্পর্কে জানা এবং বুঝা। সর্বোপরি নির্ভুলভাবে উপরোক্ত বিষয়গুলো করতে পারা। এরপর গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইল পন্যের প্রোডাকশন সক্ষমতা , প্রোডাকশন কৌশল , প্ল্যানিং সম্পর্কে ভালভাবে ধারনা নেওয়া। প্রয়োজনে এইসব নিজ চোখে দেখা এবং সিদ্ধান্তগুলো ও কাজগুলো বুঝে নেওয়া। বিশেষ ক্ষেত্রে বায়ার পোশাকের ডিজাইন মার্চেন্ডাইজারের নিকট সরবরাহ করে।
চিত্রঃ- ডিজাইন স্কেচ
তৃতীয়ত:-
বিভিন্ন উপাদান বিশেষ করে গার্মেন্টস স্যাম্পল , ফেব্রিক স্যাম্পল, ল্যাব ডিপ , ট্রিম কার্ড, সোয়াচ কার্ড এই সবের ডেভেলপমেন্ট এবং এপ্রুভাল প্রিপারেশন , রিভাইজ, টাইম ম্যানেজমেন্ট এবং ফলো আপ ইত্যাদি বিষয়গুলোতে ভালমত ধারনা রাখতে হবে।
এবং বায়ারের অর্ডার শিট, পেমেন্ট টার্ম ও শিপমেন্ট সম্পর্কে খুব ভালভাবে ধারনা নিতে হবে
এবং বিষয়গুলো বাস্তবতার আলোকে জানতে হবে।
চিত্রঃ- সোয়াচ কার্ড
চতুর্থতঃ-
ফেব্রিক প্রোডাকশন, গার্মেন্টস প্রোডাকশন, ওয়াশিং এবং গার্মেন্টসের “র” ম্যাটেরিয়ালের টেস্টসহ বিভিন্ন বিষয়গুলোর সমস্যা
বুঝতে হবে এবং সমাধান দেওয়ার পদ্ধতি জানতে হবে। এছাড়াও এক্সেসোরিস ডেভেলপমেন্ট , প্রোডাকশন প্রাইজ এবং সাপ্লাই বিহেভিয়ার, ফিনিশিং এলাউন্স, ওয়েস্টেজ পার্সেন্টেজ, বুকিং এবং সাপ্লাইয়ার সিলেকশন সম্পর্কে জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । এখানে ভুল করলে কম্পানির কোটি কোটি টাকা লোকসান হবে।
পঞ্চমতঃ-
এক্সপোর্ট, ইম্পোর্ট ডকুমেন্টস, প্রোপোমা ইনভোয়েস (পি.আই) , কমার্সিয়াল
ইনভোয়েস (সি.আই), প্যাকিং লিস্ট, শিপমেন্ট, বুকিং, ফাইনাল ইন্সপেকশন, ফ্যাক্টরি প্রোফাইল, এইচ আর ডিপার্ট্মেন্ট এবং ফায়ার সেফটি সম্পর্কে ভাল্ভাবে জানতে হবে।
সবশেষে ইয়ার্ন বুকিং, ফেব্রিক বুকিং, স্যাম্পল বুকিং, এক্সেসোরিস বুকিং এগুলো একা একা দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। তাছাড়া আপনি একজন ভাল মার্চেন্ডাইজার হতে পারবেন না।
চিত্রঃ- প্রোপোমা ইনভোয়েস
চিত্রঃ- প্যাকিং লিস্ট
এছাড়াও
মার্চেন্ডাইজিং এ শতভাগ সফলতা অর্জন করতে চাইলে একজন মার্চেন্ডাইজারকে
নিম্নে বর্ণিত পার্সোনাল স্কিলগুলো অবশ্যই রপ্ত করতে হবে।
প্রথমতঃ-
একজন মার্চেন্ডাইজারের
একটি ভুলের কারনে কোম্পানির অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে । তাই খরচের খাতগুলোকে বিবেচনায়
রাখতে হবে এবং লাভের অংক হিসাব করে পণ্যের দাম নির্ধারণ করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ-
ক্রেতার
চাহিদাকে প্রাধান্য দিতে হবে । ক্রেতা যে মানের পোশাক চাইবে অবশ্যই সেই মান
বজাই রাখার চেষ্টা করতে হবে। এই
সেক্টরে একজন ক্রেতা হারানো মানে লক্ষ লক্ষ টাকার ক্ষতি।
তৃতীয়তঃ-
একজন দক্ষ মার্চেন্ডাইজারের
অন্যতম গুণ সঠিক সময়ে শিপমেন্ট করা । সঠিক
সময়ে শিপমেন্ট করতে না পারলে এল সি অর্থাৎ লেটার অফ ক্রেডিট নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে
ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকবে।
চতুর্থতঃ-
আপনাকে ইংরেজিতে দক্ষ হতে হবে।
কারণ শতভাগ এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড ব্যাবসার প্রধান ক্রেতা হলো বিদেশি।
ফলে তাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে ,পন্যের গুনাগুন বুঝতে অবশ্যই ইংরেজি জানতে হবে।
পঞ্চমতঃ-
অবশ্যই
কম্পিউটারে দক্ষ হতে হবে।
কারন ক্রেতার সাথে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যোগাযোগ
করতে হবে ইমেইলের মাধ্যমে।
কম্পিউটারে দক্ষতা ছাড়া সেটা কোনভাবে সম্ভব
নয়।
ইন্টারনেট ব্যবহারের পাশাপাশি এম এস ওয়ার্ড,
এম এস এক্সেল জানা আবশ্যক।
সর্বপোরি
একজন দক্ষ মার্চেন্ডাইজার হতে হলে কঠোর পরিশ্রম, প্রফেশনাল স্কিল এবং বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পার্সোনাল কিছু স্কিলেরও প্রয়োজন
রয়েছে।
এবং উপরে বর্ণিত স্কিলগুলো যদি আপনারা ভাল্ভাবে
রপ্ত করতে পারেন তবে আপনি হতে পারবেন একজন প্রথম শ্রেণীর মার্চেন্ডাইজার।
*রিক্যাপ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত
*রিক্যাপ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত
Comments
Post a Comment